ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (সহকারী অধ্যাপক )
শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক হওয়া উচিত বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে। প্রতিটি ছাত্র তার শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, সবসময় বিনম্র থাকবে—যেমনটা সে তার পিতা-মাতার প্রতি করে। জ্ঞান অর্জনের প্রত্যাশা থাকবে তার প্রতিটি আচরণে। শিক্ষকের ভালোবাসা, যত্নশীলতা ও সহানুভূতি ছাত্রকে আকৃষ্ট করবে—এটাই স্বাভাবিক।
পৃথিবীতে যে যতো উপরে উঠেছে, তার কৃতিত্ব শিক্ষকের। কারণ তার উন্নতির শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রেরণা এসেছে শিক্ষক থেকেই। সত্য ও নিষ্ঠার সাথে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন মানুষকে সাফল্যের চূড়ান্তে নিয়ে যায়। এই জ্ঞান অর্জন অনেকটা সাধনার ফসল; যে যত বেশি সাধনা করতে পেরেছে, সে ততই উপরে উঠেছে। তাই শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আদর্শিক শিক্ষা হওয়া উচিত আমাদের সন্তানের।
একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। কোমলমতি শিশু যখন কিছুই জানে না, তখন শিক্ষক তাকে অক্ষরজ্ঞান দেন। তবে শিক্ষকের শিক্ষা শুধু আক্ষরিক নয়; নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধও শিক্ষকের কাছ থেকেই আসে। সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে বাবা-মা ও পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্বও কম নয়। প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হয়। পরিবারের বড়রা সন্তানের প্রথম শিক্ষক—কারণ আচার-আচরণ ও চরিত্র গঠনের শিক্ষা মূলত পরিবার থেকেই আসে। তাই প্রতিটি পরিবারকে সন্তানের প্রতিভা বিকাশে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনকে পূর্ণতা দেন। শিক্ষকের অনেক স্মৃতি আমরা কোনোদিন ভুলতে পারি না। মাতা-পিতা আমাদের জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু মানুষ করেছেন শিক্ষক। জ্ঞানীরা বলেছেন—একটি অক্ষর শিক্ষার মূল্য পৃথিবীর সব অর্থ দিয়েও শোধ করা যাবে না। তাই বলা হয়েছে, জ্ঞান অর্জন করতে, ধন-সম্পদ অর্জন নয়। কারণ জ্ঞানী ব্যক্তির প্রতি মানুষের পাহাড়সম শ্রদ্ধা থাকে; তার কাছে ধন-সম্পদ তুচ্ছ। আর এই জ্ঞান শিক্ষার পাঠশালাই হলো আমাদের শিক্ষক।
জ্ঞান প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের মধ্যে আদর্শ ও সততা থাকা অপরিহার্য। দুঃখজনকভাবে, কিছু কিছু শিক্ষক রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু দেশের মানুষ শিক্ষকদের কাছে এমন আচরণ প্রত্যাশা করে না। শিক্ষককে থাকতে হবে সাগরের মতো বিশালতায়—যাতে তাকে কোনো পক্ষভুক্ত করা না যায়। দেশের প্রতিটি শিক্ষক সবার শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে থাকলেই দেশ ও জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বদরবারে।
কিছু বাস্তব দিকও আমাদের ভাবায়। দেশের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আছেন, যাদের কাছে কোনো শিক্ষক গেলে এবং শিক্ষকের পরিচয় দিলেও গুরুত্ব পান না। অথচ যদি কোনো আর্মি বা পুলিশ অফিসার যান, তখন নরম গলায় আচরণ দেখা যায়। যেমন—একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের চেম্বারে সিরিয়াল দিয়ে বসে আছেন, ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যেই কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সিরিয়াল ছাড়া সরাসরি গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে চলে আসেন। কথাটি শুধু ডাক্তারদের ক্ষেত্রেই নয়—থানা, জেলা প্রশাসন, সর্বত্র একই অবস্থা। অথচ এই ডাক্তার, ডিসি, এসপি, সচিব—সবাই কিন্তু শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন। তাই শুধু আমার শিক্ষক এক কথা না বলে, পৃথিবীর প্রতিটি শিক্ষককে শিক্ষক মেনে সম্মান করতে পারলেই জাতি হিসেবে আমরাও সম্মানিত হবো । তবেই ছাত্রদের মধ্যেও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে।
আমাদের দেশে শিক্ষকের বাণী গুরুত্ব পায় না, গুরুত্ব পায় প্রশাসনের আমলাদের বাণী। প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় শিক্ষকের মর্যাদা প্রায় নেই বললেই চলে। এর ফলে অধিকাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হয় না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেকেই তৃতীয় বিকল্প হিসেবে শিক্ষকতা গ্রহণ করেন। অথচ একটি দক্ষ ও উন্নত জাতি গড়তে হলে সেরা মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসতে হবে। যদি প্রশাসনে শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনও প্রতিষ্ঠা পাবে। তখন অন্যান্য পেশাজীবীরাও শিক্ষকের আদর্শে নিজেদের চরিত্র গড়বে। নিঃসন্দেহে তখন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ সেরা জাতির মর্যাদা পাবে।
আজ আমাদের অভিভাবকরা চিন্তিত—সন্তান বড় হয়ে কী করবে? শিক্ষার্থীরাও মনে হতাশা নিয়ে পড়ে, উচ্চশিক্ষা নিয়েও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে থাকে। তারা বিদেশে চলে যায়, সেখানে ভাষা সংস্কৃতি কিছুই জানত না, অথচ তার মেধার ক্রমবিকাশে সেখানে একদিন তার সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। তাই এখনই সময় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার। এই দায়িত্ব দেশ ও সরকারের।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্মিলিত গবেষণার নতুন উদ্ভাবনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বে, সেই স্বপ্ন লালিত হোক জাতীয় চেতনায়। শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠুক আমাদের স্বপ্নের বাগান, আর শিক্ষক থাকুন বৃহৎ বটবৃক্ষ হয়ে চিরঅম্লান।
Leave a Reply